খোলামকুচি | দীপ ঘোষ । বই আলোচনা - রক্তিম ভট্টাচার্য
খোলামকুচি
রক্তিম ভট্টাচার্য
-----------------------------
দীপের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপ সামান্যই। বলা যায়, এই উপন্যাসটির সূত্রেই যেটুকু যোগাযোগের সাঁকো, পরবর্তীতে ক্রমশ শক্তিশালী হবে ব'লে আশাবাদী। "খোলামকুচি" উপন্যাসের পাণ্ডুলিপি পড়িয়েছিল দীপ আমায়। সগর্বে জানাই, প্ল্যাটফর্ম প্রকাশনের নাম আমিই তাকে পরামর্শস্বরূপ দিই, এবং সে-বই বেশ কিছু-দিন আগেই এসে গেছে বই-বাজারে। এখন তা-হলে প্রশ্ন উঠতে পারে, এখন এই বই নিয়ে কথা বলছি কেন? বলতে পারেন, বইমেলার প্রচার। এত এত বইয়ের ভিড়ে ক্রমপরিণত হয়ে ওঠা এক নতুন প্রকাশনের বই যদি পাঠকের হাতে যায়, এক অন্য-ভাষ্য পাঠকের কাছে সমাদৃত বা সমালোচিতও হয়, তা আমাদের কাছে শ্লাঘার। অতএব, ব্যক্তিগত অভিমতের নিরীখে কিছু কথা।
প্রথমেই বলব, এই উপন্যাসটার সম্পদ এর ভাষা। পড়তে গিয়ে কোথাও আমার বারবার হুমায়ূন আহমেদের হিমু-র কাহিনিগুলো মাথায় আসছিল। খানিকটা রমানাথ রায় মনে পড়াও অসম্ভব নয়। আশ্চর্য সাবলীল ভাষা, কবিতা অথবা মুক্তগদ্যের মতো। সরল ছন্দ মেনে চলা, অথচ তীব্র অন্তর্ঘাত। শব্দকল্প দিয়ে বাস্তব নির্মাণে মুন্সীয়ানা শিক্ষণীয়।
চরিত্র নির্মাণে আবার চমক। চরিত্রগুলো আদতে আছে না নেই - তার একটা চোরা দ্বন্দ্ব চলেছে গোটা উপন্যাস জুড়ে। চরিত্রগুলো কখনও মধ্যযুগীয় পরম্পরা মেনে নিয়তির সঙ্গে লুকোচুরি খেলে, আবার কখনও একবিংশ শতাব্দীর কুয়াশায় পরিস্ফুট হয় অবয়বের অপরিহার্যতাকে প্রশ্ন তুলেই। কে চেতন, কে অবচেতন, এই দোদুল্যমানতাটা আমার চমৎকার লেগেছে।
দৃশ্য-নির্মাণে স্বকীয়তা অনন্য। বিশেষ করে ভ্রমণ-দৃশ্যটি চমকে দিয়েছে। শিউরে উঠেছি। গোটা অংশটি আবার পড়েছি। নিপুণ অন্তর্দৃষ্টি ছাড়া এই দৃশ্যকাব্য নির্মাণ সম্ভব নয়।
ব্যক্তিগত-সত্তা এখানে গভীরভাবে উপস্থিত। রক্তদান হোক বা বিরহড় জনজীবনের অনুষঙ্গ, বা চরিত্রের নামকরণ - এই ব্যক্তি-আনয়নের ছাপটা বেশ তাৎপর্যপূর্ণ ও ইঙ্গিতবাহী। এখানেও পাঠকের সঙ্গে স্রষ্টার লুকোচুরি খেলা বিদ্যমান।
এই উপন্যাসে এক-ধরনের বিনির্মাণ লক্ষ্যণীয়। প্রকৃতির কাছে মানুষ ক্রীড়নক - ধারণাকে দীপ যেন খানিকটা সচেতনভাবেই দুমড়ে দিয়েছেন তাঁর লেখায়। বানানের স্বাভাবিকতাকে খানিকটা বিরতি দিতেই হোক, বা পারিপার্শ্বিক ও মনস্তাত্ত্বিক পরিস্থিতিকে কিছুটা সাফল্য থেকে বঞ্চিত করতে - মানুষের কাছে সময়কে অসহায় ক'রে তোলার চেষ্টায় প্রকৃতির দিকে টাইব্রেকারের চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিয়েছেন দীপ অনায়াসে।
এবার একটু সমালোচনার জায়গায় আসি। যে ভাষা স্রষ্টাকে অন্য মাত্রায় উন্নীত করেছে, সেই ভাষাই কোথাও কোথাও অতিপিচ্ছিল হয়ে খানিক বিরক্তির উদ্রেক ঘটিয়েছে। কিছু পৌনঃপুনিকতা (যা অবশ্য প্রয়োজন ছিল মনস্তত্ত্বকে গড়ে তুলতে) শেষের দিকে এসে একটু ঘ্যানঘ্যানানির মতো শুনিয়েছে। জীবনবোধের গভীর দর্শন শেষের দিকে এসে একটু অতিসরলীকৃত মনে হয়েছে। সেখানে ভাষার অটুট বন্ধনই চলনের পথে একটু অন্তরায় হয়ে উঠেছে। বলা যেতে পারে, 'তরল অতিমাত্রিকতার প্রদাহে আবেগের কোষ্ঠকাঠিন্য'।
দীপের "খোলামকুচি" বাংলা উপন্যাসে কতটা বাঁক-বদল আনবে, কত কী বিপ্লব ঘটিয়ে দেবে, সে বিচার করার দায় নেই। বরং এটুকু বলা যায়, এই লেখা নিজেকে উপন্যাস ক'রে তোলার চেষ্টা করেনি। যেমন "খোলামকুচি" চেষ্টা করেনি পাথর হতে। প্রত্যেকেই সৃষ্টির আনন্দে চলাচল করেছে আবশ্যকভাবেই।
বইটি পাওয়া যাচ্ছে কলকাতা আন্তর্জাতিক বইমেলায় প্ল্যাটফর্ম প্রকাশন-এর ৫১ নং টেবিলে। নেড়েচেড়ে দেখুন অন্তত একটু, বাকিটা বইটাই জানিয়ে দেবে।
==============================
গ্রন্থ : খোলামকুচি
লেখক : দীপ ঘোষ
প্রচ্ছদ : সুপ্রসন্ন কুণ্ডু
প্রকাশনী : প্ল্যাটফর্ম প্রকাশন
মূল্য : ১৬৫ টাকা মাত্র
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন