আমি এবং আমি | লেখক- শমীক ষাণ্ণীগ্রাহী | আলোচনা - শীর্ষেন্দু দত্ত
শমীক ষাণ্ণীগ্রাহীর গল্পের বই "আমি এবং আমি" যা ২০১৮ সালে প্রকাশিত হয়েছে।
এই সংকলনে ২৭ টি গল্প আছে। গল্পগুলোর সেই অর্থে কোন নাম নেই। আছে শুধু ক্রমিক নাম্বার। অর্থাৎ সবকটি গল্পের নামই "আমি এবং আমি"।
শমীক প্রথমেই বলেছেন, এই গল্পগুলি 'আমি' নামের এক চরিত্র কে নিয়ে। সেই 'আমি' লেখক নিজে বা পাঠক বা যে কেউ হতে পারে আবার সে হয়তো বা কোন তৃতীয় ব্যক্তি যার গল্পগুলো পড়াই হয়ে ওঠেনি এখনও। আসলে যে সত্যটা প্রতিটা মানুষ সযত্নে এড়িয়ে যেতে চায় সেটা হলো এই পৃথিবীতে "আমি''র থেকে দুর্লভ সম্পদ আমাদের নিজেদের কাছে আর কিছু নেই।
এক নম্বর গল্পটি এইরকমই আমি কে নিয়ে লেখা একটি গল্প। লেখক 'আমি' শব্দটির ব্যবহারকে অতিক্রম করতে চেয়েছেন এই গল্পে। কিন্তু আমি কে অতিক্রম করা যায় না। এই গল্পে শমীক দেখিয়েছেন আমির বদলে অনিমেষ নামটি ব্যবহার করেও আসলে আমি কে অতিক্রম করা যায়নি। বা অনিমেষ আমি কে অতিক্রম করতে পারেনি।
দ্বিতীয় গল্পটিও আমির গল্প। বা আমির আত্মপরিচয় দান পর্ব বলা যেতে পারে। গল্পটার মধ্যে একটা জেমস বন্ড ফ্লেভার কেন জানি না আমি পেলাম। ফ্লেভার মানে ফ্লেভারই। এর কোন ছায়া বা ছোঁয়া এরকম কিছু আছে আমি বলছি না।কিন্তু আমি'র এই যে লাইটটা দিয়ে সিগারেট ধরানো আমির সাথে, কেন জানিনা চোখ বুজলেই একজন জেমস বন্ডকে আমি দেখতে পেলাম যে এই মৃত নগরীতে আমি কে খুঁজে বেড়াচ্ছে!
তিন নম্বর গল্পটি ও সেই আমি এবং তুমি অথবা আমি এবং আমির গল্প। এখানে আমি একজন লেখক যার একটা ব্যালকনির খুব দরকার পড়েছে। কিন্তু ব্যালকনি না পাওয়ায় 'তুমি'র ব্যালকনিটাকেই ব্যবহার করতে চাইছে যখন 'তুমি' থাকবে না! এইটুকুই থাক, বাকিটা পাঠক নিজেরা পড়ে জানুন, রোমাঞ্চিত হন।
চতুর্থ গল্পটি হাঁটার গল্প। সুগার হবার কারণে ডাক্তার লেখককে হাঁটতে বলেছেন - গল্পের সূত্রপাত এখান থেকেই। বাকিটা আপনারা পড়বেন।
এই গল্পটি পড়তে গিয়ে বা সামগ্রিকভাবে গোটা বইটি পড়তে গিয়ে একটা কথা আমার বারবার মনে আসছে সেটা হল, গল্প কবিতা লেখার বিষয় আমাদের চারপাশে ছড়িয়ে থাকে, পথে-ঘাটে, ফুটপাতে, বাজারে, হাটে, আমাদের নিজেদের জীবনে, আমাদের বসার ঘরের চেয়ারে,শোবার ঘরের খাটে, সর্বত্র গল্প -কবিতা -লেখা ছড়িয়ে থাকে। কথাটা ঠিক আমার নয়, প্রয়াত সাহিত্যিক বারীন ঘোষালের। অর্থাৎ লেখা সর্বত্রই থাকে। তাকে দেখতে জানতে হয়। তাকে বুঝতে জানতে হয়। আর দেখা বোঝা জানার পর যখন একজন লেখক তাকে লিপিবদ্ধ করে তখনই সেটা লেখা হয়, গল্প বা কবিতা হয়। শমীককে আমি ব্যক্তিগতভাবে অনেকদিন ধরেই চিনি। ওর ব্যক্তিগত জীবন এবং ও লেখালেখি এটা আমি বেশ কয়েক বছর কাছ থেকে দেখার সুযোগ পেয়েছি। সম্প্রতি সেই সুযোগটা কমে গেছে। কিন্তু ওইটুকু দেখার সুযোগ থেকেই আমি যেন অনেক কিছু মেলাতে পারি। শমীক তার জীবনের পথ চলার সমস্ত কিছুকেই লিপিবদ্ধ করেছেন শিল্পের আকারে। একটা ইট, কাঠ,লোহা, পাথর সিমেন্টের যাপনকে কিভাবে শৈল্পিক রূপ দেওয়া যায় তা আমি অন্তত শমীকের থেকে শিখতে আগ্রহী থাকলাম।
পঞ্চম গল্পটি দুজনের কথোপকথনের গল্প। একজন লেখক যিনি গল্প লেখেন, আরেকজন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার যিনি রাস্তা বানান। বরং গল্পের একটা অংশ এখানে উদ্ধৃত করি।
" -আচ্ছা আমাকে নিয়ে একটা গল্প লিখুন না।
- আপনাকে নিয়ে গল্প! আপনাকে চিনি না,জানি না। কিভাবে আপনাকে নিয়ে লিখব বলুন তো?
- চিনে যাবেন,একটু ভালো করে খুঁজুন। ঠিক চিনে যাবেন। আমি আর আপনি সব এক। "
এও আসলে নিজের সাথে নিজের কথা বলা।আমাদের প্রতিটা মানুষের ভিতরে একাধিক সত্তা থাকে, সে রকমই 'আমি'র দুটি সত্তার কথোপকথনের গল্প এই পাঁচ নম্বর লেখাটি।
সবকটি গল্প নিয়েই কিছু বলা যায়। কিন্তু পরিসর কম তাই ইচ্ছে রইল ভবিষ্যতে কোন পত্রিকায় যদি বড় করে লেখা যায়।
একটা নির্দিষ্ট ভাবনার উপর দাঁড়িয়ে শমীক এখানে ২৭টি গল্প লিখেছেন। আমার নিজের মনে হয়েছে যে ২৭ টি গল্প নাও লিখতে পারতেন, কয়েকটি লেখা কম লিখলে ভালই হতো। আমরা যারা গল্প লিখি এরকম পরিস্থিতি আমাদের অনেকেরই এসেছে যে একটা নির্দিষ্ট থিম নিয়ে পরপর লিখে যেতে পেরেছি। কিন্তু আমার নিজের মনে হয়েছে যে একজন গল্পকারের একই বিষয়ের মধ্যে আটকে থাকা উচিত নয়। তাতে যেটা মনে হয় যে শেষের দিকে গল্পগুলোকে রাবারের মতন টেনে বড় করার চেষ্টা করে চলেছে লেখক। এখানে শমীক একজন কবি, ফলত কবিদের সিরিজ কবিতা লেখা বা দীর্ঘ কবিতা লেখার যে কৌশল সেটা হয়তো তিনি গল্পের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করতে চেয়েছেন। তাই এ জাতীয় প্রচেষ্টা অবশ্যই এক্সপেরিমেন্টাল লিটারেচার। প্রতিভাবান লেখকরাই এ জাতীয় এক্সপেরিমেন্ট করে থাকে। এই এক্সপেরিমেন্ট গুলোই আগামী দিনের লেখকদের রসদ যোগায়। লেখাগুলি ২০১২ থেকে ২০১৭ সালের মধ্যে লিখিত। বইটি বৈভাষিক প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত। প্রচ্ছদ করেছেন অনির্বাণ চক্রবর্তী। প্রচ্ছদটি ছিমছাম হলেও যথেষ্ট আধুনিক একটি বইয়ের প্রচ্ছদ হয়েছে। কিছু বানান ভুল থাকলেও বইয়ের কাজটি খুবই যত্ন নিয়ে করা হয়েছে। বইয়ের কাগজ, বইয়ের বাধাই, ডিটিপি সবই খুব ভালো মানের কাজ। আগামী দিনে গল্পকার শমীক ষাণ্ণিগ্রাহীকে আবারো দেখার ইচ্ছা রইলো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন