একটি সাহসী দৃশ্য | লেখক - বিনোদ ঘোষাল | আলোচনা: রক্তিম ভট্টাচার্য
রক্তিম ভট্টাচার্য
পড়লাম ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক বিনোদ ঘোষালের সাম্প্রতিকতম ছোটগল্পের সংকলন - "একটি সাহসী দৃশ্য"। বিনোদ ঘোষালের গল্পের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন, পাঠককে বেঁধে রাখতে জানেন তিনি। আদ্যোপান্ত সাদামাটা চলন, সহজ কথোপকথন এবং লিনিয়ার ন্যারেটিভের সরলগতিতে পরিচিত হতে থাকে গল্পের সূচিমুখ। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। লেখকের কথানুসারে, বইটির নামের মতোই একটি সাহসী নিরীক্ষাও করা হয়েছে। গল্পগুলির প্রতিটিই সব-বয়সী পাঠকের জন্য হলেও খেয়াল করলে দেখা যাবে, কোনোটি নিপাট কিশোরপাঠ্য, আবার কোনোটি আপাদমস্তক 'অ্যাডাল্ট'। এক্সপেরিমেন্টটি বৃহত্তর ক্ষেত্রে কতখানি সফল, সে বলার ক্ষমতা আমার নেই, তবে ব্যক্তিগতভাবে চমৎকার লেগেছে। বলা ভালো, একমুখাপেক্ষী বিস্তারের বাহুল্য থেকে আমাকে কিছুটা অব্যাহতি, বা বিরতি দিয়েছে।
বইটিতে চোদ্দটি গল্প বর্তমান। বিষয়বস্তুর কী অনবদ্য বিস্তৃতি! জটিল মনস্তাত্ত্বিক থেকে সরল কিশোরপাঠ্য, অপরাধের গভীর চক্র থেকে নিখাদ প্রেমের ওম। মনোজগতের ভিন্নতা ও ব্যপ্তিও ধরা পড়েছে বিভিন্ন গল্পে। "ইঁদুর"-এর চোরা ঋণাত্মক অস্বস্তি একদিকে, অন্যদিকে "ওদিকে কিছু আছে?", "ইন দ্য টাইম অফ করোনা"-র আশাবাদের আস্বাদ। নামগল্প "একটি সাহসী দৃশ্য"-র দুনিয়াটা বর্তমান সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত - এটুকু ক্লিশে কথার বেশি এগোলে স্পয়লার হয়ে যাবে। অনবদ্য লেগেছে - "নদীর নামটি কল্পনা", "লং ড্রাইভ", "শিব-কালী কথা"। প্রতিটি গল্পেই রয়েছে পরাবাস্তবতার ছোঁয়া, যা গল্পগুলি মধ্যে নিজে থেকেই একটি গোলকধাঁধা তৈরি করেছে, আর পাঠক নিজের অজান্তেই 'অ্যাবাউট টু আন্ডারস্ট্যান্ড'-র পর্যায়ে পৌঁছয়েও চোরাগোপ্তা টেনশনের মৌতাত থেকে বেরোতে পারেনি। "মিঠাই ও তার বন্ধু", "গুন্নুর জন্মদিন", "রুম নাম্বার দুশো পাঁচ" - এই তিনটি গল্পকে কিশোরপাঠ্যের তকমা দেওয়া গেলেও তার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে গভীর অনুভূতি, অলিখিত সামাজিক মূল্যবোধ, আর তীব্র সংবেদনশীল অন্তর্ঘাত - যাদের সম্মিলিত চুক্তি পাঠককে পাঠ-শেষের পর বসিয়ে রাখতে বাধ্য করে। "সৌভাগ্যের চাবি" নির্মেদ গোয়েন্দাগল্প, ও "এই বই কিনবেন না"-র নাম শুনেই যে রসের ভাবনাটি সিদাসাধা মনে উঁকি দিয়ে যায় - ঠিক সেই ভাবনারই গল্প; দ্বিতীয় গল্পটির শেষে অবয়ব পড়ে থাকে খোলসের মতো, যাকে ফেলে রাখাও যায়, আবার কুড়িয়ে বিনির্মাণ, অথবা পুনর্নির্মাণের কথাও ভাবা যায়। খানিকটা হতাশ হয়েছি "অর্পণ ও দুজন" পড়ে। জানি না কেন, গল্পটির মাঝপথেই প্রেডিক্ট করতে পেরেছি বলে কি না, মনে হচ্ছিল গল্পটিকে যেন অযথা বর্ধিত করা হয়েছে। এই একটি গল্পেই মনে হয়েছে, কিছুটা মেদবর্জন হতে পারত, বা, গল্পটি অনেক আগেই শেষ হতে পারত।
সব মিলিয়ে সংগ্রহযোগ্য একটি বই। বিনোদবাবুর ভাষানৈপুণ্য, চরিত্রনির্মাণ অনন্য। কল্পনার ধারাটি অত্যন্ত সক্রিয়। মুহূর্তে দিকভ্রান্ত ক'রে ফেলতে পারে পাঠককে (ইতিবাচক-অর্থেই বলা)। সাধারণ একটি চিত্রের মধ্যেই নির্মিত হয় পরাবাস্তবতার সিল্যুয়েট, যার সঙ্গে সমান্তরাল বাস্তবের ফারাক থাকে সামান্য-ই, ধুয়ে যেতে থাকে সূক্ষ্ম প্রাচীরটি। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি, সুগভীর জীবনবোধ, সুগঠিত দৃশ্যকল্প ও ভালোবাসার অকৃত্রিম বর্ষণ - এখানেই বিনোদবাবু অদ্বিতীয়। প্রচ্ছদের মেটাফরিক্যাল লূতাতন্তুজাল বইটির আক্ষরিক অর্থেই পরিচায়ক, বলা চলে। সহৃদয় পাঠক, অবশ্যই সংগ্রহ করুন বইটি। বিনোদবাবুর কলম আরো ক্ষুরধার হোক, এই কামনা করি।
=============================
গ্রন্থ : একটি সাহসী দৃশ্য
লেখক : বিনোদ ঘোষাল
প্রকাশক : অরণ্যমন প্রকাশনী
প্রচ্ছদ : কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল
মুদ্রিত মূল্য : দু'শো টাকা মাত্র
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন