অজিত সিং বনাম অজিত সিং – উপন্যাস, নাকি সময়ের ডকুমেন্টেশন? তৃষ্ণা বসাক | আলোচনা - রক্তিম ভট্টাচার্য

অজিত সিং বনাম অজিত সিং – উপন্যাস, নাকি সময়ের ডকুমেন্টেশন?


রক্তিম ভট্টাচার্য

-----------------------------



চরিত্র এবং ঘটনা যখন কোনও সৃষ্ট সাহিত্যের প্রবাহকে নিয়ন্ত্রণ করার সিদ্ধান্ত নেয়, তখন তা বরাবরের মতোই ধীরে ধীরে পরিপক্ক একটি আখ্যান হয়ে উঠতে চায়। নিজেকে ফুটিয়ে তোলে লেখকের হাতে, কল্পনার আঁচে জ্বাল দিতে থাকে বর্ণনার সুবাস, আর ঘন হয়ে উঠতে থাকে কাহিনির সর। কিন্তু, সময় যখন লেখাকে ঘামিয়ে তোলে নিজের ইচ্ছায়, তাকে ছোটায়, ঘোরায়, নাকে দড়ি দিয়ে দৌড় করায়, তখন তা আর নিছক লেখকের কল্পনা বা হাতের সংযমে সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং সে এক ধাক্কায় পাঠককেও শানিয়ে তোলে তার অস্থি-মজ্জায়, লেখাকে জারিত করে পরিস্থিতির উন্মত্ত বুদবুদে।


তৃষ্ণা বসাকের "অজিত সিং বনাম অজিত সিং" একটি ক্রমপরিবর্তিত সময়ের ভারী আখ্যান।



প্রথমেই আসি, নাম-চরিত্র অজিত সিং-এর কথায়। অজিত সিং একটি ভিনরাজ্যের চরিত্র, যে বাঙালিদের কোটরে ঢুকে পড়েছে ভাগ্যান্বেষণের ছিদ্র দিয়ে, কিন্তু বাঙালিদের সম্পর্কে যে ধারণা তাঁর মধ্যে ছিল, বা তাঁর দাদাজির অনুপ্রেরণায় যে বাঙালিকে সে চিনতে পেরেছিল, তার পুরোপুরি বদল ঘটেছে – সে বুঝতে পারে। দক্ষিণ কলকাতার একটি সম্ভ্রান্ত এলাকার ব্যস্ত চিত্রে তার প্রবেশ – এবং উপন্যাসের শুরুর সঙ্গে সঙ্গে পাঠক বুঝে যান, এই এলাকায় কর্মসূত্রে তার বাস হলেও মানসিকভাবে সে “other”। তার প্রেয়সী, তার স্ত্রী, তার চাহিদা, ইচ্ছা, কাজ-কর্ম, অন্বেষণ – পুরোপুরিই সম্পৃক্ত জীবনের সঙ্গে। সে উঠতে চায়, ওঠাতে চায়। একটা ক্ষমতার বৃত্তের নেপথ্যে থেকে অদৃশ্য কল্পবিন্দু হয়ে ওঠে।


এই উপন্যাসে বহু চরিত্র। শুরুর দিকের কয়েকটি অধ্যায়ে যেভাবে চরিত্রদের সঙ্গে পরপর পরিচয় ঘটে, এবং অদৃশ্য সূত্রটি বুঝে ওঠার ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তা খানিকটা ক্লান্তিকর লাগে বটে! একটানা পড়তে অস্বস্তিও হয়, মনেও থাকে না। পরক্ষণেই লেখাটির পটভূমি স্মর্তব্য হয়ে পড়ে, যা থেকে বোঝা যায় এই পরিচয়-পর্বও আসলে বয়ে চলা সময়ের দাবিরই সযত্ন অনুবাদমাত্র।


কোথা থেকে স্পষ্ট হয় সময়ের ক্রমপরিবর্তনশীল চিত্র? একটু চরিত্রদের বাদ দিয়ে ভাবতে থাকি পরিবেশটির কথা। স্থানের দিকটি দেখলে, সম্ভ্রান্ত দক্ষিণ কলকাতা, কেন্দ্রে একটি বহুল-পরিচিত, সুনামে-দুর্নামে প্রায় মিথে পরিণত হওয়া একটি বিশ্ববিদ্যালয়। আর সময়ের দিক থেকে দেখলে, রাজনৈতিক পটভূমিকার সুদূরপ্রসারী পালাবদল। বিশ্ববিদ্যালয়টিকে ঘিরে গজিয়ে ওঠা প্রাক্তন সরকারের আমলের সিন্ডিকেট-রাজ, দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকার দরুণ একচ্ছত্র স্বৈরতন্ত্রে পরিণত হতে থাকা গণতান্ত্রিক শ্রমজীবী দল, ক্ষমতায়নের আদিম শর্তে পঙ্কিল হয়ে উঠছে রাজনীতির বৃহত্তর ক্ষেত্র, বিশ্বায়নের বাজার ধীরে ধীরে গ্রাস করে নিচ্ছে মফঃস্বল থেকে নাগরিক সভ্যতার প্রতিটা বাঁক। অর্থনীতির বাজারে স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠছে শ্রেণীবৈষম্যের প্রকট দৃশ্য, আর তার মাঝেই ক্রমশ ঘুরে চলেছে প্রজন্মের পর প্রজন্ম। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে এই যে প্রজন্মের সংকট – চমৎকার চিত্রায়িত হয়েছে উপন্যাসে।


রাজনৈতিক পালাবদল হোক বা সরকারি কর্মসূচির রকমফের – লেখিকার কলমে ধরা পড়েছে শাসকের কঙ্কালসার চেহারাটাই। সূক্ষ্ম ব্যঙ্গ, সমসাময়িক ঘটনা বা শ্লোগান ব্যবহার করে সন্ত্রাসের নানা রূপের প্রতীকী সংবেদ উপস্থাপিত হয়েছে। বিশেষত, ‘এ কে ফিফটি সিক্স’ দুর্দান্ত স্যাটায়ার! এই ক্ষেত্রে একটু সাম্প্রতিক ঘটনাবলীর সঙ্গে পরিচয় না থাকলে চোরাগোপ্তা অন্তর্ঘাত ধরতে পাঠকের একটু সমস্যা হতে পারে।


অজিত সিং বাদে অন্যান্য চরিত্ররা এসেছে, আবারও, সময়ের দাবি মেনে। পার্টি অফিসের সংলগ্ন বেশ্যালয়, নেতাবৃত্তির সূচকের আড়ালে লুকিয়ে থাকা মানবজনম, স্বনামধন্য জ্যোতিষীর উপস্থিতি, প্রভাবশালী মেয়ের উঁচু থেকে আরও উঁচুতে যাওয়ার আপাত অভিসন্ধির আড়ালে কুঁচকে থাকা অভিমানের পরত, আত্মহত্যা করার আগে মৃত্যুর গন্ধ পাওয়া অজিত সিং-এর বৌ, বিভ্রান্ত পিকেবি, ভয়ার্ত দোলন, নাকি সময়ের সঙ্গে সঙ্গে পরিস্থিতিকে আত্মস্থ করেও সমাজজীবনের মানচিত্রে নিজেকে গেঁথে নেওয়া সরস চানাচুরওয়ালা – পাল্লা ভারী কার? এই উপন্যাস তার উত্তর দেয় না, শুধু না-কাহিনির একেক অধ্যায়ে প্রশ্ন তুলে যান একের পর এক।


এই কাহিনিতে যৌনতা আছে, যৌনতার আকুতি আছে, আর্তনাদ আছে, নানান পরত আছে। এক-খাবলা যান্ত্রিক কলকাতার নানান আবডালে যে ‘কোটি যোগিনীর গলি’ লুকিয়ে রয়েছে বাস্তবের সতেজ প্রশস্তিকে চেটে নেওয়ার জন্য, লেখিকা তাকে প্রায় ক্যামেরার লেন্সে তুলে ধরেছেন। চরিত্রদের সচেতন এবং অবদমিত যৌন অনুভূতির প্রকাশ, সে গৃহস্থ হোক বা ব্যবসায়িক, অকৃপণ। ভয়াবহ গণধর্ষণের অভিজ্ঞতার যে ছুঁয়ে-যাওয়া লেখা, তা পাঠককে অস্বস্তিতে ফেলতে বাধ্য।


লেখিকা ন্যারেটিভের শানে কোনও কার্পণ্য করেনি। যে …

[16:51, 03/06/2025] Raktim: পাঠ-প্রতিক্রিয়া : একটি সাহসী দৃশ্য


রক্তিম ভট্টাচার্য


পড়লাম ছোটগল্পকার, ঔপন্যাসিক বিনোদ ঘোষালের সাম্প্রতিকতম ছোটগল্পের সংকলন - "একটি সাহসী দৃশ্য"। বিনোদ ঘোষালের গল্পের সঙ্গে যাঁরা পরিচিত, তাঁরা জানেন, পাঠককে বেঁধে রাখতে জানেন তিনি। আদ্যোপান্ত সাদামাটা চলন, সহজ কথোপকথন এবং লিনিয়ার ন্যারেটিভের সরলগতিতে পরিচিত হতে থাকে গল্পের সূচিমুখ। এই বইটিও তার ব্যতিক্রম নয়। লেখকের কথানুসারে, বইটির নামের মতোই একটি সাহসী নিরীক্ষাও করা হয়েছে। গল্পগুলির প্রতিটিই সব-বয়সী পাঠকের জন্য হলেও খেয়াল করলে দেখা যাবে, কোনোটি নিপাট কিশোরপাঠ্য, আবার কোনোটি আপাদমস্তক 'অ্যাডাল্ট'। এক্সপেরিমেন্টটি বৃহত্তর ক্ষেত্রে কতখানি সফল, সে বলার ক্ষমতা আমার নেই, তবে ব্যক্তিগতভাবে চমৎকার লেগেছে। বলা ভালো, একমুখাপেক্ষী বিস্তারের বাহুল্য থেকে আমাকে কিছুটা অব্যাহতি, বা বিরতি দিয়েছে।


বইটিতে চোদ্দটি গল্প বর্তমান। বিষয়বস্তুর কী অনবদ্য বিস্তৃতি! জটিল মনস্তাত্ত্বিক থেকে সরল কিশোরপাঠ্য, অপরাধের গভীর চক্র থেকে নিখাদ প্রেমের ওম। মনোজগতের ভিন্নতা ও ব্যপ্তিও ধরা পড়েছে বিভিন্ন গল্পে। "ইঁদুর"-এর চোরা ঋণাত্মক অস্বস্তি একদিকে, অন্যদিকে "ওদিকে কিছু আছে?", "ইন দ্য টাইম অফ করোনা"-র আশাবাদের আস্বাদ। নামগল্প "একটি সাহসী দৃশ্য"-র দুনিয়াটা বর্তমান সমাজের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত - এটুকু ক্লিশে কথার বেশি এগোলে স্পয়লার হয়ে যাবে। অনবদ্য লেগেছে - "নদীর নামটি কল্পনা", "লং ড্রাইভ", "শিব-কালী কথা"। প্রতিটি গল্পেই রয়েছে পরাবাস্তবতার ছোঁয়া, যা গল্পগুলি মধ্যে নিজে থেকেই একটি গোলকধাঁধা তৈরি করেছে, আর পাঠক নিজের অজান্তেই 'অ্যাবাউট টু আন্ডারস্ট্যান্ড'-র পর্যায়ে পৌঁছয়েও চোরাগোপ্তা টেনশনের মৌতাত থেকে বেরোতে পারেনি। "মিঠাই ও তার বন্ধু", "গুন্নুর জন্মদিন", "রুম নাম্বার দুশো পাঁচ" - এই তিনটি গল্পকে কিশোরপাঠ্যের তকমা দেওয়া গেলেও তার মধ্যে লুকিয়ে রয়েছে গভীর অনুভূতি, অলিখিত সামাজিক মূল্যবোধ, আর তীব্র সংবেদনশীল অন্তর্ঘাত - যাদের সম্মিলিত চুক্তি পাঠককে পাঠ-শেষের পর বসিয়ে রাখতে বাধ্য করে। "সৌভাগ্যের চাবি" নির্মেদ গোয়েন্দাগল্প, ও "এই বই কিনবেন না"-র নাম শুনেই যে রসের ভাবনাটি সিদাসাধা মনে উঁকি দিয়ে যায় - ঠিক সেই ভাবনারই গল্প; দ্বিতীয় গল্পটির শেষে অবয়ব পড়ে থাকে খোলসের মতো, যাকে ফেলে রাখাও যায়, আবার কুড়িয়ে বিনির্মাণ, অথবা পুনর্নির্মাণের কথাও ভাবা যায়। খানিকটা হতাশ হয়েছি "অর্পণ ও দুজন" পড়ে। জানি না কেন, গল্পটির মাঝপথেই প্রেডিক্ট করতে পেরেছি বলে কি না, মনে হচ্ছিল গল্পটিকে যেন অযথা বর্ধিত করা হয়েছে। এই একটি গল্পেই মনে হয়েছে, কিছুটা মেদবর্জন হতে পারত, বা, গল্পটি অনেক আগেই শেষ হতে পারত।


সব মিলিয়ে সংগ্রহযোগ্য একটি বই। বিনোদবাবুর ভাষানৈপুণ্য, চরিত্রনির্মাণ অনন্য। কল্পনার ধারাটি অত্যন্ত সক্রিয়। মুহূর্তে দিকভ্রান্ত ক'রে ফেলতে পারে পাঠককে (ইতিবাচক-অর্থেই বলা)। সাধারণ একটি চিত্রের মধ্যেই নির্মিত হয় পরাবাস্তবতার সিল্যুয়েট, যার সঙ্গে সমান্তরাল বাস্তবের ফারাক থাকে সামান্য-ই, ধুয়ে যেতে থাকে সূক্ষ্ম প্রাচীরটি। নির্মোহ দৃষ্টিভঙ্গি, সুগভীর জীবনবোধ, সুগঠিত দৃশ্যকল্প ও ভালোবাসার অকৃত্রিম বর্ষণ - এখানেই বিনোদবাবু অদ্বিতীয়। প্রচ্ছদের মেটাফরিক্যাল লূতাতন্তুজাল বইটির আক্ষরিক অর্থেই পরিচায়ক, বলা চলে। সহৃদয় পাঠক, অবশ্যই সংগ্রহ করুন বইটি। বিনোদবাবুর কলম আরো ক্ষুরধার হোক, এই কামনা করি।

=============================


গ্রন্থ : একটি সাহসী দৃশ্য

লেখক : বিনোদ ঘোষাল

প্রকাশক : অরণ্যমন প্রকাশনী

প্রচ্ছদ : কৃষ্ণেন্দু মণ্ডল

মুদ্রিত মূল্য : দু'শো টাকা মাত্র

মন্তব্যসমূহ