শান্তিরামের চা | লেখক- বিতান চক্রবর্তী | আলোচনা- রক্তিম ভট্টাচার্য













বইটির প্রথম গল্প 'বোগেনভিলিয়া'। একটি সম্পর্কের টানাপোড়েন এই গল্পের ব্যাকড্রপ। আমরা অনেকেই জানি, এটি একটি কাঁটাগাছ, যাতে অত্যন্ত সুদৃশ্যমান ফুল ফোটে। এই গল্পটি বর্তমান সমাজজীবনের একটি প্রতিচ্ছবি, যেখানে মুখ্যচরিত্র সঞ্জীব আর্থিক অনটনের মধ্যে চাকরি জোগাড়ের চেষ্টা ক'রে তার প্রেমিকার সাথে একত্রিত হতে চায়, এবং বারবার ব্যর্থ হয়। বস্তুত, বোগেনভিলিয়ার কাঁটা এই সমাজেরই কাঁটা, যেখানে এখনও পুরুষের পেশার ওপর একটি বৈবাহিক সম্পর্ক নির্ভর করে, এবং বোগেনভিলায়ায় ফুল আসার প্রতীক্ষা হয়তো 'আচ্ছে দিন' (আভিধানিক অর্থে, সরকারি অর্থে নয়)-এর অপেক্ষা। এই কাঁটা নিয়েই বেঁচে থাকার কথা শোনায় আলোচ্য গল্পটি। দ্বিতীয় গল্প 'মিথ্যে ঘটনা অবলম্বনে' ভীষণভাবে সত্যি ঘটনা অবলম্বনে। সারদাকাণ্ডের দায়ে অভিযুক্ত স্বামীর নির্দোষ পরিবারের ভিক্ষাবৃত্তির মাধ্যমে বেঁচে থাকার গল্প। সেখানে কীভাবে কাঞ্চনা ও টুয়াকে নানা প্রতিকূলতার সম্মুখীন হতে হয়, লেখক অত্যন্ত নিখুঁতভাবে বর্ণনা করেছেন। আল্টিমেটলি, তাঁর লড়াই চালিয়ে যাওয়া সমাজের একশ্রেণীর মানুষের বেঁচে থাকার গল্প যেরকম, একইসাথে মুদির দোকানে ধারশোধের জন্য ভিক্ষা করে সামান্য টাকা জোগাড়, তাঁর স্বামীর ধারশোধের জন্য চল্লিশ লাখ টাকা জোগাড়ের সমতুল। অদ্ভুতভাবে সমাজের দুই শ্রেণীর দ্বন্দ্ব উঠে এসেছে এই গল্পে। তৃতীয় গল্প নামগল্প 'শান্তিরামের চা'। এই গল্পটি সম্ভবত এই বইয়ের সেরা গল্প‌। প্রেডিক্টেবল হলেও কীভাবে পাঠককে টেনে বসিয়ে রাখা যায়, তার অন্যতম নিদর্শন এই গল্প। চা-বিক্রেতা শান্তিরামের জীবন কর্পোরেট দুনিয়ার জৌলুসে বদলে যায়, এবং সেখানেও নিত্যনতুন টার্গেটের মোকাবিলায় একসময় পরিশ্রান্ত হয়ে সস্তার পুষ্টিকর জীবনে ফিরে আসার গল্প। চতুর্থ গল্প 'শহিদবেদি' রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে রাষ্ট্রশক্তির অসহিষ্ণুতা ও প্রগলভতার জানান দিয়েছে দৃঢ়স্বরে। 'মাওইস্ট' বলে আজ যে ছেলে গ্রামে ব্যানড, কালকেই সেই তকমা সরে যাওয়ায় তার নামে গ্রামে স্মরণসভা হবার কথা ঘোষিত হয় - ফলত শহিদবেদির 'শ' খসে পড়তে থাকে। একটি স্বল্প পরিসরের ঘটনা পৃথিবীর ইতিহাসের নগ্ন কূটনৈতিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে গভীর ইঙ্গিত দিয়ে যায়। পঞ্চম গল্প 'শীতের শহর' রোম্যান্টিক টাচে লেখা ব্যর্থতার গল্প। পাঠ শেষে মনে হয়, পুরোটাই কি স্বপ্ন? নাকি অতিমাত্রায় বাস্তব বলে তা বিশ্বাস করতে ধাঁধা লাগে - তার উত্তর পাঠকদের জন্যই তুলে রেখেছেন গল্পকার। ষষ্ঠ গল্প 'পরলেই রাজা' দেখায়, একদিনের রাজা হওয়া কীভাবে পরদিন রাজত্ব কেড়ে নেয় রাজদণ্ড অক্ষুণ্ণ থাকা সত্ত্বেও। মাঝখানের একদিন বদল যে এক সাধারণ কর্মচারীর জীবনে শুধুমাত্রই 'এক্সেপশন প্রুভস দ্য রুল', তার কথাই বলে এ গল্প। কোথাও গিয়ে এই গল্প অনেক উঠে দাঁড়ানোর কাল্পনিক কাহিনিকে ব্যঙ্গও করে, বুঝিয়ে দেয় হঠাৎ 'পলটবার' শুধু গল্পেই হয়, বাস্তবে তা কঠিন শুধু নয়, অবিশ্বাস্যও। শেষ গল্প 'হন্তারক' পরাবাস্তবিক স্বপ্নের কথার মধ্যে দিয়ে বাস্তবের রূঢ় দিকটাই দেখায়, যেখানে কিছু না পেয়েও বেঁচে থাকাটাই মানুষের একমাত্র স্বপ্ন হতে পারে।


গল্প সংকলন মানেই কিছু গল্প খুব ভালো, দু-একটি অসাধারণ, দু-একটি মাঝারিমানের - এরকম একটি হিসেব না চাইতেও থেকেই যায়। তবে এখানে অনুপাতটা এতটাই অসম যে চমকে উঠতে হয়। প্রত্যেকটি গল্প স্বতন্ত্র, একে অন্যের থেকে আলাদা। প্রতিটি গল্পই পাঠককে পাঠশেষে ভাবায়, দীর্ঘশ্বাস ফেলতে বাধ্য করায়। তুলনামূলকভাবে 'বোগেনভিলিয়া'-র শেষটা একটু দুর্বল লেগেছে, 'হন্তারক' একটু অস্পষ্ট মনে হয়েছে। 'শহিদবেদি' ও নামগল্প 'শান্তিরামের চা' এই বইটির তথা বাংলা সাহিত্যের সম্পদ।


গল্পগুলোর একটি কমন ফ্যাক্টর হল - বেঁচে থাকা। যেটা সবসময়ই (বর্তমান সময়ে খুব বেশী করে) অত্যন্ত দরকার। দৈনন্দিন ঝড়ঝাপটা , সমাজের চোখরাঙানি, প্রেম-অপ্রেম টানাপোড়েন - এতকিছু দিয়ে সাজানো ডিফেন্স চিরে গোল করাটাই মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিত এই বার্তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এই সংকলনটির। তবে প্রথাগত রীতি থেকে বেশ সরে গিয়ে নির্মেদ চলন ও সহজ যাপনের মধ্যে দিয়ে যেভাবে কথাকার কোনোরকম পক্ষপাতদুষ্ট না হয়ে এই বার্তা দিয়েছেন, তার জন্য কুর্নিশ জানাতেই হয়। যে কোনো‌ ধরনের গল্পপ্রেমীদের জন্য এই বইটি আমার মতে অবশ্যপাঠ্য।


সামান্য এক-দুটি প্রিন্টিং মিস্টেক ছাড়া বইটির আর কোনো ত্রুটি চোখে পড়েনি সেভাবে। সুন্দর বাঁধাই। প্রচ্ছদটির মধ্যেও নান্দনিকতা রয়েছে, চায়ের ভাঁড়ের মাটির প্যাঁচ, চায়ের ফেনা তীক্ষ্ণ মেটাফোর ফুটিয়ে তোলে।

==========================


বই : শান্তিরামের চা

লেখক : বিতান চক্রবর্তী

প্রকাশনা : শাম্ভবী

প্রচ্ছদ : তমোজিৎ ভট্টাচার্য

মুদ্রিত মূল্য (ভারতে) : ১৫০ টাকা মাত্র (পেপারব্যাক) ও ২০০ টাকা মাত্র (হার্ডকভার)

মন্তব্যসমূহ